সীসা দূষণে বুদ্ধি কমছে শিশুর

এ আর্টিকেলে যা থাকছে

সীসা দূষণ বর্তমান সময়ের সবচেয়ে ভয়ংকর সমস্যাগুলোর একটি। এই দূষণের ফলে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে শিশুরা। সীসা একটি শক্তিশালী নিউরোটক্সিন যা শিশুদের মস্তিষ্কে অপূরণীয় ক্ষতি করে। এই বিষাক্ত ভারী ধাতুর কারণে শিশুরা সারাজীবনের জন্য স্নায়বিক, মানসিক ও শারীরিক পঙ্গুত্বের শিকার হয়। রক্তে অতিরিক্ত সিসার কারণে শিশু মারাও যেতে পারে।

বাংলাদেশের সামগ্রিক বুদ্ধিবৃত্তিক অবনতির ৭০ শতাংশই সীসা দূষণের ফলাফল।

বেশিরভাগই মানুষই এ বিষয়ে যথেষ্ট জানে না। শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো পৃথিবীতে এ কারণে বছরে গড়ে এক লাখ মানুষ মারা যায় এ দূষণের কারণে। এ আর্টিকেলে বিশ্ব স্বাস্থ‍্য সংস্থ‍া, ইউনিসেফ ও আমেরিকার সীসা দূষণ গবেষণা বিষয়ক এনজিও ‘’পিওর আর্থ’  এর গবেষণা ও তথ‍্য ব‍্যবহার করা হয়েছে।

সীসা কী

সীসা একটি ভারী ধাতু।  এটি সাধারণত প্রকৃতিতে (মাটিতে) এবং মানুষের ব্যবহারের বিভিন্ন জিনিসপত্রে পাওয়া যায়। এই ভারী ধাতুর অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে প্রকৃতি দূষিত হয়ে পড়ে এবং মানুষ কোনোভাবে এই ভারী ধাতুর সংস্পর্শে আসলে জটিল স্বাস্থ‍্য সমস্যা হয়।

সীসা দূষণ কী

সীসার মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতিই সীসা দূষণ৷ সহজে বললে, শরীরে কোনোভাবে অতিরিক্ত সীসা ঢুকলে সেই ব্যক্তিকে সীসা দূষণের শিকার বলা হয়। সীসা বিভিন্নভাবে আমাদের শরীরে প্রবেশ করতে পারে। 

সীসাযুক্ত বাতাস শ্বাসের নেয়ার মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করতে পারে,  সীসাযুক্ত খাবার অথবা পানীয় খেলেও সীসা দূষণের শিকার হতে পারে। 

সীসা আমাদের শরীরে বিভিন্ন আচরণগত জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে। Pure Earth এর গবেষণা বলছে, পৃথিবীর প্রতি ৩ জন শিশুর ১ জন সীসা দূষণের শিকার অর্থাৎ বিশ্বের ৮০ কোটি শিশু সিসা বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত। যা প্রতিবছর আনুমানিক ৫.৫ মিলিয়ন (৫৫ লক্ষ) মানুষের মৃত্যু ঘটায়৷ 

আবার, এ দূষণে মৃত্যু হওয়া প্রায় ৯২ শতাংশ মানুষই বাংলাদেশ বা এর মতো নিম্ন, নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ।

সীসা দূষণের কারণে কী ক্ষতি হয়

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organization) বলছে, মানুষের শরীরে সীসার কোনো নিরাপদ মাত্রা নেই, অর্থাৎ অল্প পরিমাণ সীসা শরীরে প্রবেশ করলেও তা মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। সীসা দূষণের কারণে মানুষের শরীরে বিভিন্ন জটিল রোগ হয়।    

১. সীসা কোনোভাবে শরীরে প্রবেশ করলে তা মস্তিষ্ক, লিভার, কিডনি এবং হাড়ে ঢুকে যায়। এমনকি সীসা অল্প অল্প করে দাঁতেও জমা হতে পারে যার কারণে পরবর্তীতে অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা খুব বেশি। 

২. প্রেগনেন্সির সময় মায়ের শরীরে সীসা প্রবেশ করলে তা গর্ভের শিশুর বিকাশে বাধা দেয়। এমনকি এর ফলে রক্তপাত, গর্ভপাত (মিসক‍্যারেজ) ও মৃত সন্তানের জন্মও হতে পারে।

৩. সীসা দূষণের কারণে শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত। অর্থাৎ ওদের শরীর স্বাভাবিকের চেয়ে ধীরগতিতে বড় হয়। 

৪. শিশুদের আচরণগত সমস্যার একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ সীসা দূষণ।বাচ্চার শেখার,পড়ার ক্ষমতা কমে যায়। এছাড়াও সীসা দূষণের কারণে বাচ্চাদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে, ওরা উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়ে।

কৃমি হলে বাচ্চার খাবারে অনীহা তৈরি হয়
আরো পড়ুন: আমার শিশু খেতে চায় না কেন?

 

 

 

৫. সীসা দূষণের কারণে বাচ্চাদের কথা বলায় এবং আওয়াজ শোনার ক্ষেত্রেও জটিলতা দেখা দিতে পারে।  

৬. সীসা দূষণের কারণে শিশুদের হৃদপিন্ড ও মস্তিষ্ক দুর্বল হয়ে পড়ে। ওরা বড় হওয়ার পর স্ট্রোক ও হার্ট অ‍্যাটাকের আশঙ্কা খুব বেশি থাকে। 

এক কথায় বললে, সীসা দূষণ বাচ্চাদের শারীরিক, আচরণগত এবং মানসিক বিভিন্ন অসুস্থতার জন‍্য দায়ী।

কোন বয়সী বাচ্চার সীসা দূষণের আশঙ্কা বেশি

সীসা দূষণের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে শিশুদের ওপর। ৫ বছরের কম বয়সী বাচ্চারা এই দূষণের সবচেয়ে বড় শিকার। কারণ ৫ বছরের চেয়ে বড় শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় ওদের শরীর বেশি সীসা গ্রহণ করতে পারে।

৯ মাস থেকে ২ বছর বয়সী বাচ্চাদের শরীরে সীসা প্রবেশ করার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি কারণ ওরা সাধারণত ফ্লোরে, মাটিতে হামাগুড়ি দেয়। এবং স্বভাবগত আগ্রহের কারণে সামনে যা পায় তা ধরে ফেলে, এমনকি সেটা মুখেও নিয়ে নেয়।

৫ বছরের কম বয়সী শিশুরা সবকিছু মুখে দিতে ভালোবাসে




কিভাবে সীসা দূষণ ঘটে

যেহেতু শিশুদের হাতের কাছে যা পায় তা-ই ধরে দেখার ও মুখে দেয়ার প্রবণতা থাকে- তাই সীসা দূষণের মতো ভয়ংকর ক্ষতির মুখে পড়ার ক্ষেত্রে ওরাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। বাচ্চারা বিভিন্নভাবে সীসা দূষণের শিকার হতে পারে। 

আমেরিকার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশান বলছে, সীসা খাবারের মাধ্যমে, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে এবং চামড়ার মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করতে পারে।  

১. বিল্ডিংয়ের রং: আমেরিকায় সীসা দূষণ সবচেয়ে বেশি ছড়ায় বাড়ির দেয়ালের পুরোনো হয়ে যাওয়া রং থেকে। ১৯৭০ সালে আমেরিকায় সীসাযুক্ত রংের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হলেও পুরোনো বিল্ডিং এ সীসাযুক্ত ব্যবহার কমেনি।  শিশুরা সীসাযুক্ত রংয়ের আস্তরণ চিবিয়ে ফেললে, স্পর্শ করলে, এমনকি খসে পড়া রংয়ের গুঁড়ো নিঃশ্বাসের সাথে গ্রহণ করলে সীসার ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার হতে পারে। এছাড়াও, বাড়ির আবর্জনা থেকে সীসা আশেপাশের মাটিতে মিশে গেলে, সেই মাটি যদি বাচ্চারা খেলার ছলে মুখে নিয়ে ফেলে তাহলেও সীসা দূষণ ঘটতে পারে। 

২.  সীসাদূষিত মাটি: সীসাদূষিত মাটি খেলে এবং মাটিতে চাষ করা সবজি খেলে।

৩. পুরোনো খেলনা, জুয়েলারি অথবা কসমেটিকস মুখে নিলে।

৪. সীসাযুক্ত রং ব্যবহার করা হয়েছে এমন পাত্রে খাবার খেলে। সাধারণত খাবার পাত্র যেমন অ্যালুমিনিয়াম ও সিরামিকের বাসনপত্র চকচকে করতে সীসাযুক্ত রং ব্যবহার করা হয়। এসব পাত্রে রান্না করা খাবার খেলে পাত্র থেকে সীসা গলে খাবারের সাথে মিশে শরীরে ঢুকতে পারে।

৫. অনেক দিনের পুরোনো ট্যাপের পানিতে সীসা থাকার আশঙ্কা খুব বেশি।

৬. অনেক সময় বিদেশি চকলেট ও জুসের মধ্যেও সীসা থাকতে পারে। 

৭. সবসময় বাচ্চার খেয়াল রাখে, আশেপাশে থাকে এমন প্রাপ্তবয়স্ক লোক যদি সীসাযুক্ত জুয়েলারি অথবা কাপড় পরে, তবে শিশু এতে সীসা দূষণের শিকার হতে পারে। 

৮.  সীসা দূষিত মাটি বা ধুলার ছোটকণা পোশাকে বা ঘরের আসবাবপত্রে থাকলে শ্বাসের মাধ্যমে সীসা শরীরে প্রবেশ করতে পারে। 

৯. সীসা আক্রান্ত এলাকায় খেলাধুলা করলে শিশুদের চামড়ায় বিষাক্ত সীসার আস্তরণ পড়তে থাকে এবং শরীরে প্রবেশ করে মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। 

১০. বাচ্চাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে ব্যবহার করা আয়ুর্বেদিক বা পুরানো ওষুধ খেতে দিলে তা থেকে শিশুদের শরীরে সীসা প্রবেশ করতে পারে।

শিশু সীসা দূষণের শিকার কিনা কিভাবে বুঝবো

শিশুর শরীরে সীসা দূষণের প্রভাব প্রায়ই সরাসরি বোঝা যায় না। তবে বাচ্চার রক্তে অল্প পরিমাণে সীসা প্রবেশ করলেও বিভিন্ন জটিল অসুখ দেখা দিতে পারে। 

সীসা দূষণের শিকার বাচ্চাদের মধ্যে যেসব ব্যাপার লক্ষ্য করা যায় তা হলো 

১. ক্ষুধা কমে যাওয়া

২. বেশিরভাগ সময় শারীরিকভাবে ক্লান্ত,অবসন্ন অনুভব করা 

৩. মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকা 

৪. শারীরিক বৃদ্ধি ঠিকঠাক না হওয়া 

৫. বমিভাব অথবা বমি হওয়া 

৬. কোষ্ঠকাঠিন‍্য

৭. পেট ব্যথায় ভোগা 

৮. হাড়ে ব্যথা অনুভব করা

৯. মাথা ব্যথা হওয়া

১০. পড়াশোনায় অমনোযোগ বা পড়া মনে রাখতে না পারা   

এসব লক্ষণ দেখলে ডাক্তার শিশুর শরীরে সীসার পরিমাণ পরীক্ষা করে দেখেন। সাধারণ রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে শরীরে সীসার পরিমাণ জেনেই শিশু এই দূষণ আক্রান্ত কিনা তা শনাক্ত করা যায়। 

যেসব শিশুর সীসার সংস্পর্শে থাকার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি, ডাক্তাররা তাদের নিয়মিত চেকআপের সময় রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে এই পরীক্ষা করতে পারেন। আমেরিকাতে যারা পুরানো ভবন আছে এমন শহরে বাস করে, তাদের শিশুদের নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করে সীসার মাত্রা লক্ষ‍্য রাখা হয়।

বাংলাদেশের শিশু স্বাস্থ্যে সীসা দূষণের প্রভাব

সীসা দূষণ আক্রান্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ চতুর্থ। UNICEF এবং PURE EARTH যৌথভাবে একটি গবেষণা করে বের করেছে যে, বাংলাদেশের প্রায় ৩ কোটি ৬০ লক্ষ শিশু এর শিকার। এ দেশের আনুমানিক ১ কোটি শিশুর শরীরে প্রতি ডেসিলিটার রক্তে ১০ মাইক্রোগ্রামের চেয়েও বেশি সীসা পাওয়া গেছে। 

২০২৩ সালে ল্যানসেট বৈজ্ঞানিক সাময়িকীতে প্রকাশিত বিশ্ব ব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে এক বছরে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মৃত্যুর কারণ সীসা দূষণ। নিম্নমানের জিনিসপত্র, খেলনা, ভেজাল খাদ্যপণ্য ছাড়াও বিভিন্ন কারণে আমাদের দেশের বাচ্চাদের শরীরে সীসার পরিমাণ বেশি থাকে।

যেহেতু এখনো এদেশে শিশুশ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানো বন্ধ করা যায়নি, এ দূষণে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যাও কমানো সম্ভব হয়নি।

যেসব কারণে বাংলাদেশের শিশুরা সীসা দূষণে আক্রান্ত হয়

১. লেড-এসিড ব্যাটারি তৈরি করা হয় অথবা রিসাইকেল করা হয় এমন কারখানায় কাজ করা শিশুরা বেশি ঝুঁকিতে থাকে। 

২. বাংলাদেশের ভবনগুলোর দেয়ালে সীসাযুক্ত রং ব‍্যবহার করা হয় কারণ এর দাম বেশ কম। সীসামুক্ত রং পাওয়া গেলেও সেগুলি অনেক দামী হওয়াতে বাসাবাড়ি, স্কুল, কলেজ এমনকি হাসপাতালেও সীসাযুক্ত রং ব‍্যবহার করা হয়।   

৩. ব্যবসায়িরা প্রায়ই ভেজাল মসলা বিক্রি করে। মসলাকে বিশেষ করে হলুদ ও মরিচের গুঁড়া আকর্ষণীয় করতে যেসব রং মেশায় সেগুলো মাত্রাতিরিক্ত সীসাযুক্ত। এসব মসলা দিয়ে তৈরি খাবার বাচ্চাদের শরীরে সীসার প্রবেশ ঘটায়।

৪. রান্না করার জন‍্য আমরা যে অ‍্যালুমিনিয়াম এর  হাড়ি-পাতিল ব‍্যবহার করি সেগুলি থেকে সীসা বাচ্চার খাবারে মেশে। এবং খাবারের মাধ‍্যমে বাচ্চাদের শরীরে প্রবেশ করে। 

৫. ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির বর্জ‍্য থেকেও বাংলাদেশের বাচ্চারা সীসা দূষণের শিকার হয়। বাচ্চারা ইলেকট্রনিক খেলনা, বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইসের নিয়েই থাকে, আর পুরোনো  ভাঙা বা নষ্ট ইলেক্ট্রনিক জিনিস থেকে সীসা বাচ্চাদের শরীরে ঢুকে অসুখের সৃষ্টি করে। এখানে আরেকটি বিষয় মনে রাখতে হবে, ইলেকট্রনিক বর্জ‍্য ফেলার জন‍্য বাংলাদেশে কোনো আলাদা ব‍্যবস্থা নেই। এগুলি মাটির সাথে মিশে মাটিকেও ভয়াবহ দূষিত করে। এবং ওই মাটিতে ফলানো ফসল অত‍্যধিক মাত্রায় সীসাযুক্ত হয়।

বাংলাদেশের পথশিশুদের শরীরে উচ্চমাত্রার সীসা পাওয়া গেছে

৬. শহরে পথশিশুদের বেশিরভাগই বিভিন্ন আবর্জনার স্তুপে প্লাস্টিক, লোহার জিনিসপত্র কুড়িয়ে দিন কাটায়। আবর্জনার স্তুপগুলোতে বিষাক্ত সীসার পরিমাণ ভয়ংকর মাত্রায় থাকে। পথশিশুদের শ্বাসের মাধ্যমে এবং চামড়া দিয়ে প্রবেশের মাধ্যমে সীসা দূষণে আক্রান্ত হয়ে প্রাণঘাতী অসুখের শিকার হয়। 

৭. এছাড়াও ঘরোয়া ওষুধ, কসমেটিক্স থেকেও এখানকার বাচ্চারা সীসা দূষণে আক্রান্ত হয়। আয়ুর্বেদিক ও ঘরোয়াভাবে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়াটা বাংলাদেশে প্রচলিত , কিন্তু এক্ষেত্রে যেসব জিনিস ব্যবহার করা হয় তা নিয়ে খুব একটা সাবধান থাকেনা কেউ যার ফলে সীসা দূষণের আশংকা থাকে। রং ফর্সাকারী ক্রিম ও রং দিয়ে বানানো সিঁদুর সবচেয়ে বেশি পরিমাণে সীসাযুক্ত।  

সীসা দূষণের ফলে বাংলাদেশের শিশুরা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন। শিশুদের শেখার ক্ষমতা কমে যাওয়া থেকে শুরু করে স্বাভাবিক মনোযোগ ধরে রাখারা ক্ষমতা হ্রাস পায় এই দূষণের কারণে। বাংলাদেশের সামগ্রিক বুদ্ধিবৃত্তিক অবনতির ৭০ শতাংশই সীসা দূষণের ভয়াবহ ফলাফল।

সীসা দূষণ যেন না হয় সেজন‍্য কী করা যায়

সীসা দূষণ এমন একটি সমস্যা যার প্রভাব সবসময় স্পষ্ট বোঝা যায়না। দীর্ঘসময় পরে এই দূষণ বিভিন্ন জটিল এমনকি প্রাণঘাতী রোগের সৃষ্টি করতে পারে। সীসা দূষণ মোকাবিলা করতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ এবং দূষিত এলাকা থেকে দূরে থাকা উচিত। 

১. বাড়ি পুরোনো হলে দেয়ালে ব্যবহৃত রং এ সীসা আছে কিনা শনাক্ত করতে হবে। আমেরিকায় ১৯৭৮ বা এর চেয়েও পুরোনো বিল্ডিং এর রং এ সীসা উপস্থিত থাকে।  সীসার ভয়াবহ দূষণ থেকে রক্ষা করতে বাচ্চাদের অবশ্যই পুরোনো বিল্ডিং এর রং থেকে দূরে রাখতে হবে। তারা যেন কোনোভাবে রংয়ের আস্তরণ স্পর্শ অথবা খেতে না পারে৷  এছাড়াও বাড়ি পুরোনো হলে সপ্তাহে অন্তত ২ দিন ভালোভাবে ঘর মুছতে হবে। 

২. বাচ্চাদের ঘনঘন হাত ধোয়ার অভ্যাস করাতে হবে৷ এতে ঘর পুরোনো হলেও শরীরে সীসা প্রবেশের আশংকা কমবে। এছাড়াও তাদের নিয়মিত নখ কাটতে হবে যাতে নখের নিচে জমে থাকা ময়লার মাধ্যমে সীসা শরীরে ঢোকার আশংকা কমে। 

৩. পুরোনো বাড়ির আশেপাশের মাটিতে বাচ্চাদের খেলা থেকে বিরত রাখতে হবে।

৪. বাড়ি যদি কলকারখানার আশেপাশে হয় বা কোনো কারখানার ময়লা ফেলা হয় এমন কোনো নদী, পুকুর, দীঘির আশেপাশে হয় হয়, তাহলে অবশ্যই বাড়ির উঠানে বিশুদ্ধ মাটি ও ঘাস দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। 

৫.  নালা-নর্দমা পরিষ্কার রাখতে হবে যাতে সীসা দূষিত পানি ও মাটি উপচে না আসে।

৪. পানির মাধ্যমে সীসা শিশুর শরীরে প্রবেশ করার আশঙ্কা প্রবল। তাই যাদের বাড়ির পানির কল, পাইপ পুরানো তারা দিনের শুরুতে ব্যবহারের জন্য পানি নেয়ার আগে অন্তত ১০ মিনিট পানির কল ছেড়ে রাখতে পারেন। এই ১০ মিনিটে পানির সাথে বেশিরভাগ সীসা চলে যাবে এবং সীসা দূষণের আশঙ্কা কমবে৷ 

৫. বাইরে থেকে ফিরে অবশ্যই জুতা খুলে, ভালো করে পরিষ্কার করে তারপর ঘরে ঢুকতে হবে। বিশেষত সীসা আক্রান্ত এলাকা, কলকারখানার আশপাশ থেকে ফিরলে ঘরে ঢোকার আগে অবশ্যই কাপড়, জুতা ঝেড়েমুছে তারপর ঘরে ঢোকা ভালো। 

৬. নাইলন, পলিইথাইলিন এর তৈরি কৃত্রিম টার্ফ মাঠে বাচ্চাদের খেলা থেকে বিরত রাখতে হবে। 

৭. খেলার মাঠে খোলামেলাভাবে বসে খাবার অথবা পানি খাওয়া থেকে শিশুদের বিরত রাখতে হবে। 

৮.  পুরোনো খেলনা, বা বিদেশ থেকে আনা জুয়েলারী বাচ্চাদের স্পর্শ করতে দেয়া যাবেনা। 

৯. রান্নার পাত্রে সীসা আছে কিনা নিশ্চিত হতে হবে। সাধারণত পুরোনো বাসনকোসন অথবা বিদেশ থেকে আনা সিরামিক এর পাত্রে সীসা থাকতে পারে৷ যেসব পাত্র দেখতে খুব চকচকে হয় সেগুলোতে সীসা থাকার,  সবচেয়ে বেশি। তাই রান্নার হাড়ি থেকে যেন সীসা দূষণ না ঘটে সে ব্যাপারে লক্ষ্য রাখতে হবে।সবচেয়ে ভালো লোহার এবং স্টিলের তৈরি পাত্রে খাবার রান্না করা।  

১০. বাচ্চাদের নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে। তাদের খাবারে যাতে আয়রন, ভিটামিন সি এবং ক্যালসিয়াম থাকে তাই নিয়মিত ডিম, মাংস, শিমের বীজ, ফলমুল, লেবু, সবুজ মটরশুটি, টকদই, পনির ইত্যাদি খাওয়ানো যেতে পারে। নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার খেলে শরীর থেকে সীসা বের হয়ে যায়।

ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতির যুগে যদিও সীসার এই ভয়াবহ ছড়াছড়ি থেকে তাড়াতাড়ি  মুক্তি পাওয়ার আশঙ্কা কম, তবুও এই ব্যাপারে আমাদের সতর্ক হতে হবে। বাচ্চাদের সুস্থ বেড়ে ওঠার জন্য দূষণ মুক্ত পরিবেশ আবশ্যক।
বাচ্চাদের মধ্যে সীসা দূষণের চিহ্ন দেখা গেলে অবশ্যই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। সাধারণত এ সমস্যায় আক্রান্ত শিশুদেরকে ডাক্তাররা ক্যালসিয়াম, আয়রন আর ভিটামিন সি যুক্ত খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন। আমেরিকাতে বাচ্চার শরীরে সীসা পাওয়া গেলে বাড়িওয়ালা এমনকি মা-বাবার বিরুদ্ধে আইনি ব‍্যবস্থাও নেয়া হয়।

রেফারেন্স:

  1. UNICEF and Pure Earth – The Toxic Truth: https://www.unicef.org/reports/toxic-truth-childrens-exposure-to-lead-pollution-2020
  2.  PURE EARTH:  https://www.pureearth.org/bangladesh/
  3. Global health burden and cost of lead exposure in children and adults: a health impact and economic modelling analysis: https://www.thelancet.com/journals/lanplh/article/PIIS2542-5196(23)00166-3/fulltext
  4.  Centers for Disease Control and Prevention: https://www.cdc.gov/nceh/features/leadpoisoning/index.html
  5.  World Health Organization:https://www.who.int/news-room/fact-sheets/detail/lead-poisoning-and-health
  6. National Library of Medicine: https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC2672336/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *