প্রিম্যাচুর শিশু

এ আর্টিকেলে যা থাকছে

সারাবিশ্বে ৫ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর আরেকটি প্রধান কারণ হলো নির্ধারিত সময়ের আগেই শিশু জন্ম নেয়া। এ ধরনের শিশুদের আমরা সাধারণত “প্রিম‍্যাচুর শিশু” নামে জানি। ২০১৯ সালে অকালে বা আগেই জন্মানোর কারণে প্রায় ৯ লাখ শিশু মারা গেছে।

প্রিটার্ম শিশু কারা?

যেসব শিশুর জন্ম ৩৭ সপ্তাহের আগে হয়েছে তাদের প্রিটার্ম (Preterm) ধরা হয়৷ শিশু মায়ের পেটের ভিতর কতদিন ধরে আছে সেই সময়ের উপর ভিত্তি করে, নির্ধারিত সময়ের আগে জন্ম নেয়া শিশুদেরকে কয়েক ভাগে ভাগ করা হয়।। যেমন:

  • মারাত্মক প্রিটার্ম (extremely preterm),  (যারা ২৮ সপ্তাহের আগে জন্মায়)
  • অতিরিক্ত প্রিটার্ম very preterm (২৪ সপ্তাহ থেকে ৩২ সপ্তাহের মাঝে যারা জন্মায়)
  • প্রিটার্ম moderate to late preterm (৩২ সপ্তাহ থেকে ৩৭ সপ্তাহের মাঝে যারা জন্মায়)

ডেলিভারি ডেট এর আগেই প্রসব ব্যথা উঠে যাওয়ার কারণে যেসব বাচ্চার জন্ম হয় তাদেরকে মূলত প্রিটার্ম শিশু বলা হয়। আবার অনেক সময় মায়ের শারীরিক অবস্থা যদি বেশি খারাপ হয়ে যায় তাহলে দ্রুত সিজার করে ফেলতে হয়, একারণেও প্রিটার্ম শিশু জন্মায়।

সময়ের আগে দ্রুত জন্মানোর কারণে এই প্রিটার্ম শিশুগুলোর সারা জীবন ধরে অনেক ধরনের সমস্যা বয়ে বেড়াতে হয়-

  • কোন কিছু শেখার অক্ষমতা 
  • ভালোমতো কানে শুনতে না পাওয়া 
  • ভালোভাবে দেখতে না পাওয়া

বাংলাদেশের মতো একটি নিম্ন আয়ের দেশে প্রিটার্ম শিশু বাঁচিয়ে রাখা অনেক কঠিন। ৩২ সপ্তাহ বা তারও আগে যে শিশুগুলো জন্মায় তাদেরকে বাঁচানো প্রায় সম্ভব হয় না বললেই চলে। স্বল্পআয়ের মানুষ হাসপাতালের খরচই চালাতে পারে না। এছাড়াও প্রিটার্ম শিশুর অনেক বেশি যত্নের প্রয়োজন হয় যেটা তারা করতে পারে না।

ঠিকভাবে বুকের দুধ খাওয়াতে না পারা, বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ হওয়া সহ, অক্সিজেনের ঘাটতির কারণে শিশু মারা যায়। একটি প্রিটার্ম শিশু জন্মানোর সাথে সাথেই অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে হয় কারণ এই শিশুদের শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা থাকে। অনেক হাসপাতালেই এই অক্সিজেন এর ব্যবস্থা থাকে না। উন্নত দেশগুলোতে প্রিটার্ম শিশু বাঁচিয়ে রাখা আমাদের তুলনায় সহজ, কারণ তারা প্রযুক্তিগত দিক থেকে অনেক এগিয়ে। কিন্তু মধ্যম-আয়ের দেশগুলোতে এই উন্নত প্রযুক্তি না থাকার ফলে প্রিম‍্যাচুর শিশু বাঁচিয়ে রাখার সংখ্যা অনেক কম। আর বেঁচে থাকলেও তারা সারা জীবন কোন না কোন অক্ষমতা বয়ে বেড়ায়।
নির্ধারিত সময় বা ডেলিভারি ডেটের আগে কেন একটি শিশুর জন্ম হয়?

কেন ডেলিভারি ডেটের আগে শিশুর জন্ম হয়, তার সব কারণ এখনো জানা যায় নি। কোন কারণ ছাড়াই, এমনি এমনিও একটি প্রিটার্ম শিশু জন্ম নিতে পারে।

কিছু ক্ষেত্রে গর্ভবতী মায়ের বিভিন্ন ধরনের শারীরিক জটিলতা; যেমন: রোগের সংক্রমণ বা অন্যান্য জটিলতার কারণে ডেলিভারি ডেটের আগেই সিজারিয়ান ডেলিভারি (Caesarean  Delivery) করা হয়।

মা যদি একাধিকবার প্রেগন্যান্ট হয় বা কোন রোগের সংক্রমণ হয় অথবা যদি দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ থাকে, সেক্ষেত্রে তার শিশু নির্ধারিত সময়ের আগেই জন্ম নিতে পারে।

কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিশু আগে জন্ম নেয়ার কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। একটি শিশুর নির্ধারিত সময়ের আগে কেন জন্মায় তা বোঝার জন্য আরো গবেষণা করা প্রয়োজন।

কোন দেশে এবং কখন প্রিটার্ম ( Preterm) শিশু বেশি জন্মায়?

দক্ষিণ এশিয়া ও সাব-সাহারান আফ্রিকার দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি প্রিটার্ম শিশু জন্মায়। যদিও এই সমস্যাটা এখন সারা বিশ্বব্যাপী। প্রিটার্ম শিশুর বেঁচে থাকা নির্ভর করে সে কোন দেশে জন্মগ্রহণ করেছে তার ওপর। যেমন ধরুন, বাংলাদেশের মতো একটি নিম্ন আয়ের দেশে যদি অতিরিক্ত প্রিটার্ম শিশু (যাদের জন্ম ২৮ সপ্তাহের আগে) জন্মায়, তাহলে ৯০% এর বেশি মারা যায়। অন্যদিকে একটি উন্নত দেশ, যেমন- আমেরিকায় মাত্র ১০% মারা যায়।

কিভাবে এই অকাল জন্ম প্রতিরোধ করা যায়?

গর্ভবতী মায়ের সুস্থ থাকা অনেক বেশি জরুরী। বলা হয়ে থাকে, একজন সুস্থ মা-ই পারে একটি সুস্থ সন্তান জন্ম দিতে। গর্ভকালীন সময়ে মায়ের যদি কোনো বড় ধরনের শারীরিক সমস্যা না থাকে তাহলে ডেলিভারি ডেটের আগে শিশু জন্মানো প্রতিরোধ করা কিছুটা হলেও সম্ভব।আর যদি প্রিটার্ম শিশু জন্ম নেয়, জন্মানোর পর শিশুটির প্রচুর যত্ন নেয়া ও তার পরবর্তী জীবনের জটিলতা প্রতিরোধ করার জন্যও মাকে সুস্থ থাকতে হবে। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), একটি শিশুর নির্ধারিত সময়ের আগে জন্ম নেয়া প্রতিরোধ করতে, প্রেগন্যান্ট মেয়েদের সুস্থ থাকার কিছু দিক নির্দেশনা দিয়েছে-

  • গর্ভবতী মাকে প্রচুর পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে।
  •  তামাক দ্রব্য ব্যবহার করা যাবে না 
  • একজন মা কত মাসের গর্ভবতী এবং একাধিক শিশু কনসিভ (Conceive) করেছে কিনা তা জানার জন্য শুরুতেই আল্ট্রাসাউন্ড (Ultrasound)  করতে হবে
  • প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর থেকে পুরো গর্ভকালীন সময়জুড়ে কমপক্ষে ৮ বার ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত। যাতে করে সংক্রমণের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কারণগুলো আগে থেকেই জানা যায় এবং সেগুলো প্রতিরোধ করা যায়।


ছবি: ( বিশ্ব স্বাস্থ‍্য সংস্থা)

যদি একজন মায়ের নির্ধারিত সময়ের আগেই শিশু জন্ম নেয় বা জন্মানোর ঝুঁকি থাকে, তবে সেই শিশু জন্মানোর পর ভবিষ্যতে যেন তার মাথায় কোন সমস্যা দেখা না দেয়, শ্বাসকষ্ট বা অন্যান্য রোগের সংক্রমণ না হয় তার জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থা আছে। চিকিৎসা ব্যবস্থা গুলো হল-

প্রসবকালীন স্টেরয়েড (Steroids) এবং টোকোলাইটিক (Tocolytic) চিকিৎসা, যা দ্রুত বাচ্চা প্রসব করা আটকায় এবং মেমব্রেনের প্রিটার্ম প্রলেবার (PPROM) ফেটে যাওয়ার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হয়।*

২০২২ সালে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)  প্রিটার্ম শিশু যত্ন নেওয়ার কিছু নতুন পদ্ধতির কথা  বলেছে যেমন-

  • শিশু জন্মানোর সাথে সাথে শিশুকে মায়ের বুকে দিতে হবে, মায়ের বুকের ওম এই সময়ে শিশুর জন্য খুবই জরুরী। এই পদ্ধতি কে ক্যাঙ্গারু কেয়ার (Kangaroo Mother Care) বলা হয়।
  • যত দ্রুত সম্ভব শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো।
  •  ক্রমাগত ইতিবাচক শ্বাসনালী চাপের ব্যবহার (CPAP)। মানে হল, শিশুকে উচ্চমাত্রার অক্সিজেন দিতে হবে যেন শিশুর শ্বাস নিতে কষ্ট না হয়।
  • প্রিটার্ম শিশুর শ্বাসকষ্টের জন্য ক্যাফিন (Caffeine) নামক ওষুধ ব্যবহার করতে হবে। এই ওষুধ দিয়ে প্রিটার্ম বা কম ওজনের বাচ্চাদের মৃত্যুহার অনেকটা কমানে সম্ভব।

একজন মা এবং পরিবারই পারে তাদের শিশুটির সর্বোচ্চ যত্ন নিতে। সঠিক যত্নে এই শিশুরা দ্রুত ভালো হয়ে উঠতে পারে।শিশুকে অবশ্যই সবসময় মায়ের কাছে রাখতে হবে। গুরুতর অসুস্থতা ছাড়া মায়ের থেকে কখনো দূরে রাখা যাবে না। মায়ের বুকের দুধ খুবই জরুরী এই শিশুদের জন্য। নির্দিষ্ট সময় পর পর মায়ের বুকের দুধ খাওয়ান, শিশুকে রোদে দেয়, সময়মতো গোসল করানো, অতিরিক্ত ঠান্ডায় বা অতিরিক্ত গরমে শিশুকে না রাখা, পরিবারের সকলকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা এবং শিশু যে জায়গায় থাকবে সেটা সর্বোচ্চ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। এগুলো অনুসরণ করে শিশুকে প্রচুর যত্ন করলে শিশু দ্রুত সেরে উঠবে। শিশুর পরিবারকে সাহায্য করার জন্য অভিজ্ঞ স্বাস্থ্যকর্মীদের উচিত সব সময় তাদের বাড়িতে যাওয়া ও পরিবারের মানুষদের কাউন্সেলিং করা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এর নির্দেশনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা(ডব্লিউএইচও) শিশুদের স্বাস্থ্য সমস্যা ও সময়ের আগে জন্মানো শিশু মৃত্যুহার কমানোর জন্য কাজ করার প্রতিশ্রুতি নিয়েছে। এর সদস্য রাষ্ট্র ও অংশীদাররাও একসাথে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, প্রেগন্যান্ট মেয়েদের কিভাবে চিকিৎসা করা প্রয়োজন, প্রিটার্ম শিশু জন্মানোর ঝুঁকি কমানোর জন্য কি কি করনীয়, প্রিটার্ম শিশু ও কম ওজনের শিশুদের কিভাবে যত্ন নিতে হয়, এ সকল বিষয় নিয়মিত গবেষণা করে এবং তাদের নির্দেশনাবলিতে নতুন নতুন তথ্য যোগ করে। যেন মায়েরা সর্বোচ্চ সর্তকতা অবলম্বন করতে পারে এবং সঠিক উপায়ে শিশুর যত্ন নিতে পারে।

* চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ সেবন করবেন না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *