বাচ্চার পটি ট্রেনিং এর সময় যেসব সমস‍্যা হয়

এ আর্টিকেলে যা থাকছে

বাচ্চাকে পটি ট্রেনিং দেওয়ার সময় বেশিরভাগ বাবা-মাই বিব্রতকর সমস‍্যায় পড়েন। কখনো বাথরুম থেকে বের হবার সাথে সাথে বাচ্চা প্রস্রাব বা পায়খানা করছে অথচ বাথরুমে করছে না, কখনোবা পায়খানা বা প্রস্রাবে হাত দিচ্ছে।  পটি ট্রেনিং দেওয়ার সময় অধিকাংশ বাবা-মা যে ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়ে থাকেন তা নিয়েই এ লেখাটি।

আরো পড়ুন: কোন লক্ষণ দেখলে বোঝা যায় বাচ্চা পটি ট্রেনিংয়ের জন‍্য প্রস্তুত

বাচ্চা যদি ঘন্টার পর ঘন্টা প্রস্রাব পায়খানা না করে থাকতে পারে এবং পটি ব্যবহারেও আগ্রহ দেখায়, তাহলে এমন মনে হতেই পারে যে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে পটি ট্রেনিং দিতে খুব বেশি সময় লাগবে না।

কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, সবসময় এমনটা হয় না। পটি ট্রেনিং বেশ সময় সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। আপনার বাচ্চাকে বাথরুমে যাওয়ার অভ্যাস করতে কয়েক মাস এমনকি ১ বছর সময়ও লাগতে পারে। 

অন্য সবকিছুর মতোই, একেক শিশু একেক বয়সে পটি ট্রেনিংয়ের জন্য প্রস্তুত হয়। সাধারণত ২ থেকে সাড়ে তিন বছরের মধ্যে শিশু বাথরুমে গিয়ে প্রস্রাব পায়খানা করা শিখে যায়। 

আপনার বাচ্চা এই সমস্ত কাজগুলো একা করতে পারলেও, মাঝে মাঝে কিছু দুর্ঘটনা ঘটে যেতেই পারে।

এখানে পটি ট্রেনিং এর কিছু সাধারণ সমস্যা, বিপত্তি এবং সেগুলো কিভাবে মোকাবেলা করা যায় সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

শিশু হঠাৎ জামাকাপড়ে প্রস্রাব-পায়খানা করে ফেলছে

যে সমস্ত বাচ্চারা একটানা কয়েক সপ্তাহ এমনকি কয়েক মাস কাপড় না ভিজিয়ে থাকতে পারে, অর্থাৎ প্রস্রাব-পায়খানার উপর নিয়ন্ত্রণ চলে আসে, প্যান্টে করে ফেলে না, তারাও হঠাৎ করে আবার কাপড়ে পটি করা শুরু করতে পারে এবং আবারো ডায়পার ব্যবহার করতে হতে পারে। একে পটি ট্রেনিং রিগ্রেশান বলে। এটা মোটেও অস্বাভাবিক না। 

প্রথমেই বাচ্চার স্বাস্থ্যগত কোন সমস্যার কারণে এমন হচ্ছে কিনা তা খুঁজে বের করতে হবে। যেমন ধরুন পায়খানা শক্ত বা কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণে বাচ্চার ঘনঘন প্রস্রাব হতে পারে ( পেটে পায়খানা জমে থাকলে মূত্রাশয়ে চাপ পড়ে যার ফলে বাচ্চার ঘনঘন প্রস্রাব পায়)। এমনকি প্রস্রাবের রাস্তায় ইনফেকশনের (UTI)  কারণেও ঘনঘন প্রস্রাব হতে পারে। শিশুর ক্ষেত্রে কোন সমস্যাটা হচ্ছে সেটা খুঁজে বের করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা করাতে হবে। 

বাচ্চার জীবনের বড় ধরনের পরিবর্তনগুলোও পটি ট্রেনিং রিগ্রেশান এর কারণ হতে পারে অর্থাৎ শিশুর জীবনে বড় কোনো পরিবর্তন আসলে প্রস্রাব পায়খানার ওপর নিয়ন্ত্রণ চলে আসার পরেও শিশু কাপড়ে পটি করে দিতে পারে। 

যেমন নতুন ভাই-বোন আসা শিশুর জীবনের অনেক বড় একটি পরিবর্তন। অথবা তাকে ডে-কেয়ার বা প্রি স্কুলে পাঠানো হচ্ছে – এই সমস্ত ঘটনাগুলো শিশুর জীবনে চাপ সৃষ্টি করতে পারে। যার ফলে সে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে মানে কাপড়ে পটি করে দিতে পারে। শিশুর এই নতুন পরিবর্তন গুলোর সাথে খাপ খাওয়াতে কয়েক সপ্তাহ সময় লাগতে পারে, কিন্তু ভালো ব্যাপার হচ্ছে, একবার পটি ব্যবহার করা শিখে গেলে শিশু আর সেটা ভোলে না, তাই পরিবর্তনের সাথে একবার অভ্যস্ত হয়ে গেলেই সে  আবার পটি ব্যবহার করতে শুরু করবে। 

কিন্তু এই সময়ের মধ্যে, আপনার সন্তানকে চাপ দেয়ার চেষ্টা করবেন না এমনকি সে যদি দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে তাকে লজ্জা দেবেন না। এমনটা করলে বাচ্চার উপর আরো বেশি চাপ সৃষ্টি  হতে পারে, যা শুধুমাত্র পটি ট্রেনিং রিগ্রেশনকে আরো দীর্ঘায়িত করবে। বাচ্চাকে চাপ না দিয়ে সহজ ভাবে বুঝিয়ে বলুন যে মাঝে মাঝে এমন দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক, এতে লজ্জার কিছু নেই এবং পরবর্তীতে এমন দুর্ঘটনা যেন আর না ঘটে সেই ব্যাপারে সে চেষ্টা করতে পারে। 

বিছানা ভেজানোর ক্ষেত্রে, মনে রাখবেন যে অনেক বাচ্চাই সারারাত প্রস্রাব না করে থাকতে পারেনা। বাচ্চা কখনো কখনো ৬/৭ বছর বা তারও বেশি বয়স পর্যন্ত  রাতে বিছানা ভিজিয়ে ফেলতে পারে। এমনও হতে পারে যে আপনার শিশু টানা কয়েক সপ্তাহ ধরে রাতে বিছানা ভেজাচ্ছে না, কিন্তু হঠাৎ করেই আবার ভেজানো শুরু করলো। সেক্ষেত্রে, সব থেকে ভালো উপায় হল যতদিন পর্যন্ত না সে এক সপ্তাহ বা তারও বেশি সময় বিছানা না ভিজিয়ে থাকতে সক্ষম হচ্ছে ততদিন তাকে রাতে ট্রেনিং প্যান্ট বা ডায়পার পরানো। একবার সক্ষম হলে আবার ডায়পার না পরিয়ে রাখার চেষ্টা করতে পারেন। 

অন‍্য জায়গায় করলেও পটিতে বসে পায়খানা করতে চায় না

আপনার বাচ্চার পায়খানা করার প্রিয় জায়গা কি টেবিলের নিচ, খাটের নিচ বা বসার ঘরের কোণ? অনেক বাচ্চাদের পায়খানা করতে কিছু অসুবিধা হয়, এমনকি বাথরুমের কমোডে বসে পায়খানা করার পর পায়খানা অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখেও তারা বেশ বিচলিত হয়। 

ধাপে ধাপে সমস্যাটি মোকাবেলা করার চেষ্টা করুন। প্রথমে যখন বাচ্চার প্রস্রাব-পায়খানার চাপ আসবে তাকে পটি করতে বাথরুমে নিয়ে যান, এতে বাচ্চা পটি করা এবং বাথরুমের যাওয়ার মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে বুঝতে পারবে। এরপরে তাকে কমোডে থাকা পটি খালি করার জন্য ফ্লাশ করতে বা পানি ঢালতে উৎসাহ দিন।

বাচ্চা যদি ফ্লাশের শব্দ ভয় পায়, তাহলে ফ্লাশ করার সময় জোরে জোরে হাততালি দিন এবং তার খুব প্রশংসা করুন যেন সে ফ্লাশের শব্দ বেশি শুনতে না পায় । অথবা একটি পটি ট্রেনিং সিট ব্যবহার করতে পারেন যেটাতে আলাদা ট্রে থাকে, এতে বাচ্চার পটি শেষ হলে সে বাথরুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর পায়খানা বাথরুমের কমোডে ফেলে ফ্লাশ করে দিতে পারবেন। 

সময়ও একটি বড় ভূমিকা রাখে,বাচ্চার পায়খানা না আসলে তো সে পায়খানা করতে পারবেনা ।তাই তাকে কখন পটিতে বসাবেন সে ব্যাপারে কৌশলী হতে হবে। সে যদি প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে পায়খানা করে, তাহলে ঠিক সেই সময়ে তাকে পটিতে বসতে উৎসাহ দিন। 

আর যদি তার পায়খানা করার সময়টা নিয়মিত না হয় অর্থাৎ একেক দিন একেক সময় করে তাহলে সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর বা খাবারের পরে তাকে পটিতে বসানোর চেষ্টা করবেন কারণ খাওয়া জিআই ট্র্যাক কে উদ্দীপ্ত করতে পারে এবং পায়খানা করতে সাহায্য করতে পারে।

বাচ্চা পটি ব্যবহারই করতে চায় না

বাচ্চারা সহজে নতুন কিছুর সাথে মানিয়ে নিতে পারেনা। শুরুতে পটি ব্যবহার করাও তার কাছে সম্পূর্ণ নতুন একটি অভিজ্ঞতা।তাই এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, অন্যান্য সমস্ত নতুন জিনিসের মতো শুরুতে সে টয়লেট ব্যবহার করতে চাইবেনা। তাই প্রথমে তাকে বোঝাতে হবে, মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে হবে। তাকে বলুন সে যখন পটিতে বসার জন্য তৈরি হবে বা বসতে চাইবে তখনই সে ব্যবহার করবে তার আগে না। এতে সে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে এবং পটি ট্রেনিং এ উৎসাহ পাবে। 

আপনি শিশুকে তার নিজের পটি চেয়ারটি পছন্দ করে কিনতে বলতে পারেন বা বাচ্চাদের বড় আন্ডারপ্যান্ট পছন্দ করে কেনার অনুমতি দিতে পারেন। এছাড়াও যখনই সে টয়লেটে বসে পটি করবে তখন তাকে তার পছন্দের কিছু যেমন খেলনা, স্টিকার, গাড়ি, পুতুল পুরস্কার হিসেবে দিন। এতে সে উৎসাহ পাবে। মাথায় রাখতে হবে যে বাচ্চাকে কোনোভাবেই চাপ দেওয়া যাবে না তাই এতকিছুর পরেও সে যদি পটি ট্রেনিং এ আগ্রহ না দেখায় তাহলে আরো ১-২ সপ্তাহ অপেক্ষা করে আবার শিশুকে চেষ্টা করতে উৎসাহ দিতে শুরু করুন।

মনে রাখবেন, পটি ব্যবহার করার ‘ভুল’ উপায় বা পদ্ধতি বলে কিছু নেই। কিছু বাচ্চা হয়তো কমোডের সিটে বসেই পটি করতে চায় (কিছুক্ষেত্রে, বাচ্চাকে পটি ট্রেনিং দেয়ার এইটাই সব থেকে সহজ উপায়),  অন্যদিকে কিছু বাচ্চা হয়তো কমোডের রিমের উপর উবু হয়ে বসে পটি করতে পছন্দ করে। বাচ্চা যেভাবেই বসুক, প্রস্রাব-পায়খানা ঠিকভাবে টয়লেটের ভেতর গেলেই হলো।

বাচ্চা প্রস্রাব-পায়খানা নিয়ে খেলছে

বাচ্চারা স্বভাবতই খুব কৌতূহলী হয়, কখনো কখনো এই কৌতূহল নিজেদের প্রস্রাব-পায়খানা পর্যন্ত গড়ায়। তার ক্ষমতার উপর নির্ভর করে, বাচ্চা হয়তো তার পায়খানা নিয়ে খেলতে পারে বা হয়তো কিছু অদ্ভূত জায়গায় রাখার চেষ্টা করতে পারে। বড় হওয়ার সাথে সাথে তার কল্পনাশক্তি ও বাড়তে থাকে, যার ফলে এমন বিভিন্ন দুষ্টুমি করে বেড়ায়। 

বাচ্চার এসব কান্ডকারখানা দেখে আপনি হয়তো প্রথমে খুব আতঙ্কিত হয়ে পড়বেন। কিন্তু আতঙ্কিত হয়ে খুব বেশি প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে ফেলবেন না। বাচ্চারা মনোযোগ পছন্দ করে তাই আপনার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্যই সে কাজটি বারবার করতে পারে। যখন সে আপনার থেকে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া পাবে না, তখন তাদের এই কাজ করার আগ্রহও কমে যাবে। 

প্রতিক্রিয়া দেখানোর পরিবর্তে তাকে শান্তভাবে বলুন, “চলো পায়খানাটা কমোডে ফেলে দিই এবং ফ্লাশ করে দূরে সরিয়ে দিই”। এরপরে, সাবান ও পানি দিয়ে তার হাত খুব ভালোভাবে ধুতে সাহায্য করুন। এতে করে তার একটা ভালো অভ্যাস গড়ে উঠবে এবং বুঝতে পারবে টয়লেটে গেলে সব সময় সাবান দিয়ে হাত ধুতে হয়। 

বাথরুম থেকে বের করার সাথে সাথেই প্রস্রাব-পায়খানা করছে

অনেকসময় দেখা যায় বাচ্চাকে পটিতে বসালে সে একদমই প্রস্রাব-পায়খানা করছে না কিন্তু পটি থেকে ওঠানোর কিছুক্ষণ পরেই হয়তো এখানে সেখানে করে দিচ্ছে। এমন কেন হয়?

আপনার হয়তো মনে হতে পারে আপনার বাচ্চা একগুঁয়ে বা অবাধ্য সেজন্য সে ঠিক করে পটি করে না, কিন্তু আসলে তা না। কিভাবে মূত্রাশয় পুরোপুরি খালি করে প্রস্রাব করতে হয় বাচ্চাদের তা শিখতে অনেকটা সময় লেগে যায়। কখনো কখনো করতে বলা হলে হয়তো প্রস্রাব করার সময় মূত্রাশয় আংশিক খালি করতে পারে। যেমন, কখনো কখনো বাচ্চাকে বালতি বা বাথটাবের ভেতর উষ্ণ গরম পানিতে বসানো হলে তাদের পেশী আরো শিথিল হয়ে গিয়ে প্রস্রাব এমনকি পায়খানার বেগ আসতে পারে। অথচ বাচ্চা হয়তো টেরই পায়নি যে তার মূত্রাশয়ে প্রস্রাব জমা ছিল। 

তাছাড়া কিছু বাচ্চা পটিতে বসানোর কয়েক মিনিট পরেই অধৈর্য হয়ে যায় এবং পটি শেষ না করেই তাড়াতাড়ি উঠে যেতে চায়। অন্য সময় বাচ্চারা পটি করার সময় এতটাই মগ্ন থাকে যে তারা বুঝতেই পারে না কোন দিক দিয়ে পটি করা হয়ে গেছে এবং সেটা টয়লেটের ভেতর চলেও গেছে।

যখন আপনার বাচ্চা একটু বড় হবে তখন তার মস্তিষ্ক এবং মূত্রাশয় আরো পরিপক্ব হবে ফলে মস্তিষ্কের সাথে মূত্রাশয়ের আরো কার্যকরী সংযোগ তৈরি হবে। তখন প্রস্রাব পায়খানার চাপ আসলে বাচ্চা বুঝতে পারবে যে এখন তাকে বাথরুমে যেতে হবে এবং পটিতে বসার আগ পর্যন্ত সে প্রস্রাব পায়খানা ধরে রাখতে পারবে। 

আপাতত আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে ইতিবাচক বা পজিটিভ থাকা এবং বাচ্চাকে উৎসাহ দেয়া। পটি ট্রেনিং এর সময় কয়েকবার অবস্থার অবনতি হতে পারে, বা বাচ্চা কিছুদূর এগিয়ে আবার পিছিয়ে যেতে পারে। এটা খুবই স্বাভাবিক। দুশ্চিন্তা করবেন না, বিপত্তি আসলেও সে আবার দ্রুত পটি ব্যবহার করা শুরু করবে এবং ডায়পার পুরোপুরি বাদ দিতে পারবে।

 

 

Reference

  1. American Academy of Pediatrics, Emotional Issues and Potty Training Problems, May 2022. 
  2. American Academy of Pediatrics, Create a Potty Training Plan for Your Child, May 2022. 
  3. American Academy of Pediatrics, Bedwetting: 3 Common Reasons & What Families Can Do, December 2021.
  4. American Academy of Pediatrics, Increasing Confidence and Self-Esteem During Toilet Training, November 2009.
  5. American Academy of Pediatrics, Toilet Training

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *