বাচ্চার স্ক্রিনটাইম নিয়ে জানা এখনকার বাবা মায়ের জন্য খুবই জরুরি। অনেক বাবা-মাই মনে করেন বাচ্চাকে খানিকক্ষণ সময় টিভি বা মোবাইল দেখতে দিলে তারা একটু ফুরসত পান। বা তাদের জন্য সুবিধা হয়। মনে রাখবেন, ২ বছরের আগে কোনো ধরনের স্ক্রিনটাইম দেয়া ঠিক নয়। তবে যদি আপনার জন্য এটা একান্তই আবশ্যক হয়, আপনি বাচ্চাকে ‘স্ক্রিনের নেশা’ থেকে মুক্ত রাখার জন্য প্রথম থেকেই সঠিকভাবে স্ক্রিনটাইম দিন।
মোবাইল না টেলিভিশন? সম্ভব হলে অবশ্যই টেলিভিশন। এবং এর রিমোট আপনার হাতে। কখনোই বাচ্চাকে টিভি বা মোবাইল নিয়ন্ত্রণ করতে দিবেন না।
১৮ থেকে ২৪ মাস বয়সী বাচ্চারা টিভি বা মোবাইল দেখে যে সময়টুকু কাটায় সেটুকু সময় শিশুদের শুধুমাত্র শিক্ষামূলক ভিডিও বা অনুষ্ঠান দেখানো উচিত। কিন্তু তা অবশ্যই দেখাতে হবে অভিভাবক বা বড় কারো উপস্থিতিতে।
গবেষণায় দেখা গেছে, এ বয়সের বাচ্চাদের কার্টুন বা কোনো ভিডিও দেখে সেখানে কী কী ঘটছে সেটা বুঝতে পারার দক্ষতা তৈরি হয়না। যেমন ধরুন, টিভিতে দেখা একটা ডাইনোসরের ছবিকে শিশু তার আশেপাশে দেখা পশু বা পাখির সাথে মেলাতে পারেনা।
কিন্তু শিশু যদি টিভি বা মোবাইলে কোনো অনুষ্ঠান দেখে ঘটনাপ্রবাহ বা কীসের পর কী হচ্ছে তা বুঝতে পারে এবং ধরতে পারে যে স্ক্রিনে সে যা কিছু দেখছে তা আসলে বাস্তব জীবনেরই জিনিসপত্র এবং মানুষের প্রতিচ্ছবি তবেই সে অনুষ্ঠানটা থেকে কিছু শিখতে পারবে। সহজ ভাষায়, সে যদি ভিডিওতে কাউকে ব্রাশ করতে দেখে, তাহলে সে মেলাতে পারবে যে সে আপনাকেও ব্রাশ করতে দেখে।
টিভি বা মোবাইল স্ক্রিনে আমরা যা দেখি সেগুলো যে বাস্তব জগতেরই প্রতিচ্ছবি সেটা বুঝতে পারাকে সিম্বলিক থিংকিং বলে। বাচ্চাদের মধ্যে ১৮ মাস বয়স থেকে সিম্বলিক থিংকিং তৈরি হতে শুরু করে এবং পুরোপুরি তৈরি হতে প্রায় ৩ বছর বয়স পর্যন্ত সময় লাগে। তার আগে টিভি বা মোবাইলে যা দেখছে বা শুনছে তা বোঝার জন্য শিশুর বাবা-মা বা কোনো অভিভাবকের সাহায্য দরকার হয়।
বাচ্চার সামনে টিভি বা মোবাইল ছাড়ার আগেই কোন অনুষ্ঠান দেখাবেন সেটা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিন। আপনি নিজে যদি ওর সামনে বারবার পরিবর্তন করতে থাকেন, ও নিজেও বারবার বদলে দেখতে চাইবে। মানে মনোযোগ দেয়া শিখবে না।
আমি যে চারটি অনুষ্ঠান ভালো মনে করি:
Daniel the Tiger
Clifford the big red dog
Number Blocks By BBC
Sesame Street (বাংলায় আছে সিসিমপুর নামে)
এগুলোকে ভালো মনে করার কারণ হলো এগুলিতে কোনো লাফালাফি, উত্তেজক গান এবং বাজে শব্দ নেই। খুবই সরল সুরের গান এবং খুবই সাদামাটা দৈনন্দিন জীবনের কার্যকলাপ (ব্রাশ করা, হাত ধোয়া, পটি ট্রেনিং, বাসে চড়া, বেড়াতে যাওয়া বা বল দিয়ে খেলা) সুন্দরভাবে বোঝানো আছে।
কোন বয়সের শিশু দিনে কত ঘণ্টা মোবাইল/ টিভি দেখা উচিত
এএপি (The American Academy of Pediatrics) এর নির্দেশনা অনুযায়ী ২৪ ঘণ্টায় বাচ্চাকে কতক্ষণ টিভি/মোবাইল দেখাবেন তা নিচে দেয়া হল।
২ বছর বয়সের আগে কোনো স্ক্রিনটাইম নয়।
২-১২ বছর বয়সীর জন্য সারাদিনে ১ ঘণ্টা
১৩- পূর্ণবয়স্ক মানুষের জন্য সারাদিনে ২ ঘণ্টা
টিভি বা মোবাইল বাচ্চাকে দেয়ার পাঁচটি টিপস
১ কার্টুন দেখার সময় কার্টুনের চরিত্রগুলো নিয়ে শিশুর সাথে কথা বলুন। চরিত্রগুলো কী করছে, ওদের কেমন লাগছে, ওদের কী মন খারাপ নাকি খুশি নাকি রেগে আছে এসব নিয়ে শিশুর সাথে কথা বলুন, তাকে প্রশ্ন করুন। যেমন বলতে পারেন “বড় পাখিটার মন খারাপ কেন বলোতো! মনে হয় সে তার খেলার বলটি খুঁজে পাচ্ছে না।” গবেষণায় দেখা গেছে যেসব চরিত্রের সাথে বাচ্চারা মানসিক একটা সম্পর্ক তৈরি করতে পারে সেসব চরিত্র থেকে তারা শেখে বেশি। তাই ভিডিওতে দেখা চরিত্রগুলোকে নিয়ে শিশুর সাথে গল্প করলে, প্রশ্ন করলে শিশুর চরিত্রগুলোর সাথে সম্পর্ক তৈরি করা সহজ হয়।
২ মোবাইল বা টিভির পর্দায় শিশু যা দেখছে তার সাথে বাস্তব জীবনের সম্পর্ক বুঝতে তাকে সাহায্য করুন। দ্বিমাত্রিক (2D) স্ক্রিন এর সাথে ত্রিমাত্রিক (3D) বাস্তব জীবনের মিল তৈরির জন্য শিশুর মস্তিষ্কের জটিল নিউরাল কানেকশনের দরকার হয়। কোনো অনুষ্ঠান বা চরিত্রের অভিজ্ঞতার সাথে বাচ্চার বাস্তব অভিজ্ঞতার মিল দেখানো গেলে তা তাকে নতুন জ্ঞান এবং সে যা জানে তার সাথে নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনে সহায়তা করে।
যেমন, বাচ্চাকে পটি ট্রেনিং দেয়ার আগে এ সংক্রান্ত ভিডিও দেখানো যায়। দেখিয়ে বলা যায় “দেখো ওদের বাথরুমে কল আছে, আমাদের বাথরুমের কলটার মত। ও পিপি আসলে বাথরুমে চলে যায়!” খাবার নিয়েও একইভাবে বলতে পারেন।
৩ অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পরে, যেসব শব্দ এবং ঘটনা প্রোগ্রামে শিশু শুনতে বা দেখতে পেয়েছে সেগুলো নিয়ে কথা বলুন যাতে শিশুর মাথায় সেগুলো গেঁথে যায়। সারা দিনে বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠনে শোনা শব্দ এবং কী ঘটেছিল সেগুলো শিশুকে মনে করিয়ে দিন: “মনে আছে ঘরের বাইরে যাওয়ার আগে রাজপুত্র রুমগুলো পরিষ্কার করেছিলো?তেমনিভাবে এখন আমাদেরকেও ঘর পরিষ্কার করতে হবে”। এভাবে পছন্দের কোনো চরিত্রের সাথে যুক্ত করে নতুন কোনো ধারণা বা নতুন শব্দ শেখা বাচ্চাদের জন্য সহজ হয়।
৪ অনুষ্ঠানে দেখা বিভিন্ন অংশ নিয়ে অভিনয় করা যায়। এভাবেই বাচ্চা হয়তো অভিনয় বা ‘প্রিটেন্ড প্লে’ করতে শুরু করবে। শিশু অনুষ্ঠানে যা দেখেছে তার কিছু অংশ বা ঘটনা নিয়ে অভিনয় করলে সে অনুষ্ঠানে কী দেখেছিলো এবং যা দেখেছে সেটা বাস্তব জীবনে আসলে কীভাবে ঘটে তা বুঝতে শিশুর সুবিধা হয়। যেমন ধরুন, কার্টুনে শিশু দেখলো একটা বাঘ তার ছোট্ট বোনকে গোসল করতে সাহায্য করছে, তখন আপনিও বাচ্চার ছোট্ট পুতুলকে গোসল করানোর অভিনয় করে শিশুকে দেখান।
৫ অনুষ্ঠান দেখার সময় শিশুর সাথে কথা বলার আগে ভিডিও পজ করে নিন। ভিডিও পজ করে শিশুর সাথে সে কী দেখেছে তা নিয়ে কথা বলার জন্য গল্পের মধ্যে কোনো বিরতি আসা পর্যন্ত কিংবা একটা অংশ শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। গল্পের মাঝখানেই শিশুর সাথে কথা বলতে শুরু করলে ভিডিওর কথা, শব্দ, গান, ছবি এবং আপনার কথা- সব মিলিয়ে শিশু দিশেহারা হয়ে যেতে পারে। শিশু যখন খুব মন দিয়ে অনুষ্ঠান দেখছে তখন পজ করে শিশুর সাথে কথা বলা সবসময় সহজ হবে না, কিন্তু যত দ্রুত শিশুকে পজ করার ব্যাপারটাতে পরিচিত করা যাবে, তত আপনার এবং শিশু দুজনের জন্যই ব্যাপারটা স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
৬ সবসময় স্ক্রিনটাইম আপনার নিয়ন্ত্রণে রাখুন। কখন দেখতে দেবেন, কী দেখতে দেবেন এবং কতক্ষণ সেটা আপনার নিয়ন্ত্রণে থাকা জরুরি। এ বয়সী বাচ্চাদের দিনে ১ ঘণ্টার বেশি স্ক্রিনটাইম দেয়া ঠিক নয়। তাই প্রতি বেলাতেই ১০ মিনিট পরেই অনুষ্ঠানের এমন কোনো অংশ যেখানে থামা যাবে, অনুষ্ঠান থামিয়ে টিভিকে বাই বাই বলে দিন।
রেফারেন্স:
১. Barr, R., Zack, E., Garcia, A., & Muentener, P. (2008). Infants’ attention and responsiveness to television increases with prior exposure and parental interaction. Infancy, 13(1), 30-56.
২. Council on Communications and Media, Hill, D., Ameenuddin, N., Reid Chassiakos, Y. L., Cross, C., Hutchinson, J., Levine, A., … & Swanson, W. S. (2016). Media and young minds. Pediatrics, 138(5), e20162591.
৩. Strouse, G. A., Troseth, G. L., O’Doherty, K. D., & Saylor, M. M. (2018). Co-viewing supports toddlers’ word learning from contingent and noncontingent video. Journal of Experimental Child Psychology, 166, 310-326.
৪. Zack, E., & Barr, R. (2016). The role of interactional quality in learning from touch screens during infancy: Context matters. Frontiers in Psychology, 7, 1264.